:: মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ :: “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে”- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এঁর এ কবিতার সঙ্গে অনেকটাই মিলে গেছে লালমনিরহাট জেলার ৫টি (লালমনিরহাট সদর, আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা, পাটগ্রাম) উপজেলার নদীগুলোর চিত্র। তবে তা বৈশাখে নয়, চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় এ অবস্থা। কোনো নদীতেই পানি থাকে না। তাই পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায় এ নদী। মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃণ এলাকা বিরান বালুভূমিতে পরিণত হয়ে নদীর গতিপথ পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জনসাধারণ এ অঞ্চলের বৃহৎ নদী তিস্তা হেঁটেই পার হচ্ছেন। খেয়াঘাটের নৌকাগুলো এক জায়গায় করে পারাপারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিস্তায় এক হাঁটু পানিও নেই। ক্ষীণ হয়ে এসেছে নদী। নেই কোনো নাব্যতা। জেগে উঠেছে অসংখ্য চর-ডুবোচর। বালুচরের দিগন্ত জুড়ে সবুজ মাঠে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা। আলু, তামাকসহ বিভিন্ন ফসল তোলার ধুম পড়েছে তিস্তাসহ নদীর চরে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসে বালু। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছর বছর তলদেশ ভরাট হওয়ায় লালমনিরহাট জেলার নদীগুলো হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। এক সময় দূর- দূরান্ত থেকে তিস্তা হয়ে ব্যবসায়ীরা আসতেন বাণিজ্য করার জন্য। সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। বর্ষায় সহজেই নদীর দুই কূল ছেপে আসে বন্যা। ভাঙ্গে আবাদি জমি-জমা, ঘর-বাড়ি। নিঃস্ব হয় হাজার হাজার পরিবার।
আরও জানা গেছে, নদীতে মাছ ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা আজ অসহায়। পানি না থাকায় জেলেরা পেশা বদল করে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট-বড় নদীগুলো কালক্রমে ভরাট হয়ে, পানি শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষাবাদ। আর পানি না থাকায় দুর্দিন চলছে মৎস্যজীবীদের মধ্যে। নদীগুলোর মধ্যে প্রধানত তিস্তা, বুড়ি তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, স্বর্ণামতি, সানিয়াজান, সাকোয়া, মালদহ, ত্রিমোহীনি, মরাসতি, গিরিধারী, গিদারী, ধোলাই, শিংগীমারী, ছিনাকাটা, ধলাই, ভেটেশ্বর। যে নদীগুলো লালমনিরহাট জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তার দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৪শত কিলোমিটার। এসব নদীর বুকে এক সময় পাল তোলা নৌকা চলত, কালের পরিক্রমায় সেই নদীর বুকে এখন ঋতুভিত্তিক নানা ফসল ফলানো হয়। তাই দেখে বোঝার উপায় থাকে না এটি এক সময় নদী ছিল। লালমনিরহাট জেলার বেশ কিছু নদ-নদী এখন প্রায় বিলীন। এ রকম কয়েকটি নদ-নদী- লালমনিরহাটের চাতলা, দেউল।
লালমনিরহাট জেলার অনেকগুলো নদ-নদীতে বোরো মৌসুমে এখন ধানের চাষ হয়। লালমনিরহাটের সতী, চাতলা, মালদহ, সাঁকোয়া, ভেটেশ্বের, স্বর্ণামতি, রত্নাই নদীতে ধান ফলানো হয়। তিস্তায় ধান-ভুট্টাসহ বিভিন্ন শস্য উৎপাদিত হচ্ছে।
তিস্তাঃ হিমালয়ে তিস্তার উৎস। ভারতের সিকিমের পর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলা হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের দহগ্রাম হয়ে ঢুকেছে তিস্তা। তিস্তার ডান পারে নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা; রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলা। আর বাঁ পারে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলা এবং কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা। সবশেষে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।
ধরলাঃ এ নদী পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার পাহাড়ী অঞ্চলের জলাশয় থেকে বের হয়ে ময়নাগুড়ির পশ্চিম পাশ বেয়ে চেংড়াবান্ধায় কোচবিহারে প্রবেশ করেছে। তারপর চেংড়াবান্ধার পূর্ব পাশ ঘেঁষে কিছুটা দক্ষিণ পূর্বে প্রবাহিত হয়ে বুড়িমারীতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যেখানে উক্ত নদী সোজা পূর্বমুখী হয়ে পাটগ্রামের উত্তর পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহি হয়ে মাথাভাঙ্গা শিতলকুচিতে ভারতে প্রবেশ করে লালমনিরহাট জেলার লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট, কুলাঘাট-কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।
ত্রিমোহনীঃ হাতীবান্ধা উপজেলার দক্ষিণে ডাউয়াবাড়ীর কাছে তিস্তা নদীর এক সরু ধারা থেকে এ নদীর উৎপত্তি। তারপর কালীগঞ্জে প্রবেশ করে এঁকেবেঁকে চন্দ্রপুর হয়ে পূর্ব-দক্ষিণ আদিতমারী উপজেলায় প্রবেশ করেছে। তারপর সোজা দক্ষিণ-পূর্বে কমলাবাড়ী, নামড়ির বিল, সারপুকুর হয়ে লালমনিরহাট সদর উপজেলার কিসামত হারাটির নিকট প্রবেশ করেছে। এরপর লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটির পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে মহেন্দ্রনগর হয়ে গোকুন্ডা ইউনিয়নের পাশ দিয়ে তিস্তা ষ্টেশনের কাছে তিস্তা নদীতে মিশেছে।
স্বর্ণামতিঃ কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রামের নিকটবর্তী বিভিন্ন বিল থেকে এ নদীর উৎপত্তি। তারপর চলবলা গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আদিতমারী উপজেলায় প্রবেশ করে পূর্ব-দক্ষিণ হয়ে সারপুকুর ভাদাই মৌজা অতিক্রম করে লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি, গোকুন্ডা ইউনিয়নের ভিরত দিয়ে ত্রিমোহনীর সাথে তিস্তা ষ্টেশনের কাছে তিস্তা নদীতে পড়েছে।
সাকোয়াঃ মেকলিগঞ্জ (পাটগ্রাম) থেকে উৎপন্ন হয় দহগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ধাপড়াহাটে কুচুলিবাড়ীতে ভারতে প্রবেশ করেছে। তারপর বাউরায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে সানিয়াজান নদীর সাথে মিশে।
শিঙ্গিমারীঃ পাটগ্রামের পশ্চিম উত্তরে ধবলসতি গ্রামের আরও পশ্চিমে এক দোলা থেকে প্রবাহ শুরু করেছে। তারপর পাটগ্রাম শহরে মির্জাকোটের কাছে শিঙ্গিমারী নামধারণ করে বাউরা হয়ে সানিয়াজান নদীতে মিশেছে।
সানিয়াজানঃ ভারতের মেকলিগঞ্জ ধাপড়াহাট অঞ্চলে উৎপত্তি হয়ে পানাবাড়িতে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর বাউরার দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্বমূখী হয়ে সতীনদীতে মিশিছে।
রত্নাইঃ লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের দীঘলটারি গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দক্ষিণে ভেলাবাড়ী হয়ে দক্ষিণ-পূর্বমুখী হয়ে মোগলহাট দুড়াকুটি-কুলাঘাট ইউনিয়নের বনগ্রাম হয়ে চর খাটামারী মৌজার দক্ষিণে ধরলার সাথে মিলিত হয়েছে।
অনেকের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদীগুলোর পলি অপসারণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, নদীগুলো পপি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে নদীগুলোতে এখন কোনো পানি নেই। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে সব খেয়াঘাট। তাই মানুষ হেঁটেই পার হচ্ছেন নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রটি দাবি করেছে, নদীগুলো খনন করে পানি প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
[লেখক: মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ, কবি ও সাংবাদিক এবং নদী গবেষক, লালমনিরহাট। ০১৭৩৫৪৩৮৯৯৯, ই-মেইল: mashudranaseries@gmail.com]